সংক্ষিপ্ত বাহাই পরিচিতি
- বাহাই বিশ্বাস
বিশ্বশান্তি ও একতার জন্য বাহা'ই শিক্ষা
— শৌগী এফেন্দী
"যিনি তোমাদের প্রতিপালক, পরম দয়ালু, তিনি সমগ্র মানবজাতিকে এক আত্মা ও এক দেহ হিসাবে দেখার আকাঙ্ক্ষা তাঁর অন্তরে লালন করেন।"
— বাহা’উল্লাহ
কতিপয় মূলনীতি
০১
সকল ধর্মের ভিত্তি এক
প্রত্যেক ধর্মই বিশাল এক স্বর্গীয় জ্যোতি। হিংসা, দ্বেষ বা ঘৃণার জন্য ধর্ম নহে। ধর্ম হলো সত্য এবং সত্য এক ও অভিন্ন। সুতরাং সৃষ্টিকর্তার ধর্মের মূলও এক। ধর্মের মূল বিষয়গুলির মধ্যে কোন পার্থক্য বা পরিবর্তন নাই। পার্থক্য সৃষ্টি হয় অন্ধ অনুসরণ, কুসংস্কার এবং পরবর্তীতে মানব সৃষ্ট আচার-অনুষ্ঠানের ফলে। ভিন্ন-ভিন্ন ধর্মানুসারীদের আচার অনুষ্ঠানের মধ্যে পার্থক্যের কারণে মানবজাতীর মাঝে মতানৈক্য এবং দ্বন্দ্ব-বিবাদের সৃষ্টি হয়।
০২
সার্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা
বাহা’ই ধর্মের একটি মৌলিক শিক্ষা- সার্বজনীন এবং বাধ্যতামূলক শিক্ষা। বাহা’উল্লাহ্ শিক্ষাদানকে মহত্তম পেশা বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেছেন : “মানুষকে একটি অমূল্য রত্নসমৃদ্ধ খনির ন্যায় বিবেচনা করিবে, শুধুমাত্র শিক্ষাই তার রত্নাবলী প্রকাশিত করিতে এবং উহা হইতে মানবজাতিকে লাভবান হইতে সমর্থ করিবে।”
০৩
নারী-পুরুষের সমানাধিকার
এক শতাব্দীরও পূর্বে বাহা’উল্লাহ ঘোষণা করলেন যে, সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ উভয়ই সমান। তিনি বলেছেন যে, “আগামী দিনগুলিতে নারীরা সামাজের সকল বিষয়ে অংশগ্রহণ করিবে এবং বিশ্বের উচ্চতম মর্যাদা অর্জন করিবে।” বাহা’ই লিখনাবলীতে বলা হয়েছে। নারীরা বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করিবে, কেননা তারা প্রকৃতিগত ভাবে যুদ্ধ বিরোধী।
০৪
বিজ্ঞানের সাথে ধর্মের সমন্বয়
০৫
স্বাধীনভাবে সত্যান্বেষণ
সত্যানুসন্ধান করাই হলো অন্যতম বাহা’ই শিক্ষা। মানুষের উচিৎ স্বাধীনভাবে সত্যানুসন্ধানে রত হওয়া। বাহা’উল্লাহ্ বলেন- “তুমি স্বচক্ষে এবং অপরের চক্ষু ব্যতিরেকে দর্শন করিবে, এবং নিজ বোধশক্তি বলে এবং পৃথিবীর অন্য কারোও বোধশক্তির সহায় ব্যতীত জ্ঞান লাভ করিবে।”
০৬
দারিদ্র্য এবং প্রাচুর্যের মধ্যে চরম ব্যবধানের অবসান
বাহা’ই শিক্ষা অনুযায়ী ‘মানুষের পারিপার্শ্বিক অবস্থা এমন হতে হবে যাতে প্রাচুর্যতা এবং দারিদ্রতার মধ্যকার চরম সীমা কমানো যেতে পারে। নিজ নিজ শ্রেণির অবস্থা অনুসারে প্রতিটি মানুষ যথাসম্ভব সুখে এবং শান্তিতে বসবাস করতে পারে।
০৭
সকল প্রকার কুসংস্কার বর্জন করতে হবে
০৮
একটি সার্বজনীন ভাষা
একটি আন্তর্জাতিক ভাষা গৃহীত হবে। জগতের সমস্ত বিদ্যালয়ে ইহা শিক্ষা দেওয়া হবে। প্রত্যেক ব্যক্তিকে কমপক্ষে দুটি ভাষা শিখতে হবে। একটি আন্তর্জাতিক ও অন্যটি মাতৃভাষা।
ইতিহাস
উনবিংশ শতাব্দির মধ্যভাগে যখন প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্য উভয়ে সমভাবে পার্থিব অধার্মিকতার তমোরাশি থেকে বহির্গত হওয়ার সংগ্রামে প্রবৃত্ত, ঠিক সেই সময়, নবযুগ ঘোষণা করে বাহা’ই ধর্ম আত্মপ্রকাশ করে।
১৮৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ২৩শে মে তারিখে ইরানে বা’ব (দ্বারপথ) নামে পরিচিত এক দিপ্তীমান যুবক ঘোষণা করলেন যে, সকল ঐশী ধর্মের প্রতিশ্রুত মহামানব শিক্ষাদাতা সহসা আবির্ভূত হবেন, যিনি সকল আত্মাকে সঞ্জীবিত, মানব মনকে আলোকিত, তাদের চরিত্রকে পুনঃগঠিত এবং সমস্ত মানবজাতিকে একতাবদ্ধ করবেন।
১৮৬৩ সালে বাহা’ উল্লাহ (১৮১৭-১৮৯২) ঘোষণা করলেন যে, তিনিই বা’ব এবং সকল ঐশী ধর্মের প্রতিশ্রুত মহামানব। বাহা’উল্লাহ পারস্য সম্রাটের একজন বিশিষ্ট মন্ত্রীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি পূর্ব-পশ্চিমে এই আনন্দবার্তা প্রচার করলেন যে, মানবজাতির উপস্থিত সঙ্কটময় মুহূর্তে পুনঃসঞ্জীবিত করার জন্য পবিত্র পরমাত্মা পুনর্বার আবির্ভূত হয়েছেন এবং এক নতুন ও বৃহৎ যুগের আরম্ভ সূচিত হয়েছে, ইহা হচ্ছে মানবজাতির একতার যুগ, পরম প্রভুকে জানার এবং চেনার যুগ। মানবজাতি এবং সকল ধর্মের ভিত্তি এক, তাঁর এই শিক্ষা প্রচারের ফলে অজ্ঞতা এবং ধর্মোন্মাদনার শক্তিসমূহ বাহা’উল্লাহর বিরুদ্ধে উত্থিত হয় এবং তাঁকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়। তাঁর বিষয়-সম্পত্তি ও সর্বপ্রকার অধিকার হতে তাঁকে বঞ্চিত করা হয়; তাঁকে তেহরান থেকে বাগদাদ, কনষ্টান্টিনোপল, আদ্রিয়ানোপল এবং সর্বশেষে ১৮৬৮ সালে চরমদণ্ডস্বরূপ প্যালেষ্টাইনের কার্মেল পর্বতের নিকটে তৎকালীন তুরস্ক সাম্রাজ্যের দণ্ডিত অপরাধীর উপনিবেশ জনশূন্য আক্কা নগরীর সেনানিবাসে যাবজ্জীবন অবরোধ করা হলো।
অবরুদ্ধ অবস্থায় ১৮৯২ সালে তিনি স্বর্গারোহণ করেন। সেই সময় থেকে তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র আব্দুল বাহা’র অনুপম ভক্তি, জীবনের পবিত্রতা, অক্লান্ত চেষ্টা, অপরিসীম বিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই বাহা’ই ধর্ম ধীরে ধীরে ও নিশ্চিতরূপে পৃথিবীর সর্বত্র প্রসার লাভ করে। আব্দুল-বাহা অতি শৈশব থেকেই তাঁর পিতার সমস্ত নির্বাসন ও দুঃখ-কষ্টে অংশীদার ছিলেন। স্বয়ং বাহা’উল্লাহ তাঁকে বাহা’ইদের কেন্দ্র এবং একমাত্র ব্যাখ্যাকারীরূপে নিয়োগ করেছিলেন। ১৯২১ সালে তাঁর স্বর্গারোহনের পর বাহা’ইদের একতা এবং বাহা’ইদের আদর্শগুলির পবিত্রতা, বাহা’ই ধর্মের অভিভাবক, আব্দুল-বাহা’র দৌহিত্র শৌগী এফেন্দীর দ্বারা পরিচালিত ও রক্ষিত হয়। ১৯৬৩ সালে বাহা’ই পবিত্র লিখনাবলীতে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুযায়ী বাহা’ইদের সর্বোচ্চ পরিচালনা পরিষদ ‘সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয়’ প্রতিষ্ঠিত হয়। সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয় বিশ্বের সমগ্র জাতীয় বাহা’ই সমাজসমূহ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা প্রতি পাঁচ (৫) বৎসর অন্তর নির্বাচিত হয়। সার্বজনীন ন্যায় বিচারালয় ধর্মের উন্নতির পথ নির্দেশ করেন এবং বিকাশমান বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি বাহা’উল্লাহর শিক্ষাবলীর প্রয়োগ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় আইন-কানুন বিধিবদ্ধ করেন।